এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি কী? এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির প্রকৃতি আলোচনা কর।
ভূমিকা: "Indian society has no history at all, at least no known history " ভারতবর্ষের সমাজব্যবস্থার কোনো ইতিহাসই নেই, অন্ততপক্ষে কোনো জাত ইতিহাস নেই। ভারতবর্ষ সম্পর্কিত নিশ্চলতা ও স্থবিরতাকে কেন্দ্র করে মার্কসের এরূপ চিন্তাধারার ফলস্বরূপই এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির মতো সাধাসিধে উৎপাদন পদ্ধতির জন্ম। মূলত পাশ্চাত্যের উন্নতির সাথে সাথে প্রাচ্যের তুলনামূলক পার্থক্য করতে গিয়ে মার্কস Asiatic Mode of Production বা এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ধারণার জন্ম দেন।
পাশ্চাত্য সমাজের শ্রেণিসংগ্রাম ও উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাখ্যার জন্য মার্কস যে ধারণার অবতারণা করেন তা এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যুক্তিযুক্ত ছিল না। তাই মার্কস এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাখ্যা করার জন্য Asiatic Mode of Production প্রত্যাটির ব্যবহার করেন এবং এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে পাশ্চাত্যের উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে পৃথক বুঝানোর জন্য তার কতকগুলো বৈশিষ্ট্যও তুলে ধরেন। এ বৈশিষ্ট্যগুলো এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য বলে পরিচিত।
এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি (Asiatic Mode of Production)
এটি এশিয়ার উৎপাদন সংগঠনের বিশেষ প্রক্রিয়া। পাশ্চাত্য সমাজের শ্রেণিসংগ্রামের এবং উৎপাদন সম্পর্কের বিশ্লেষণ মার্কস ঐতিহাসিকভাবে Ancient এগুলোর সাহায্যে তদানীন্তন এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার যথাযথ ব্যাখ্যা Feudal এবং Bourgeoise mode এর উল্লেখ করেছেন। সম্ভব নয় বলে, এশিয়ার বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি Asiatic mode of production প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন।
এশীয় এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী F. Tokei তাঁর Primitive Communal System গ্রন্থে বলেছেন, "এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি হচ্ছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন কাঠামো যা আদিম সাম্যবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা এবং প্রাচীন মধ্যবর্তী উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যবর্তী পর্যায়ে দেখা যায়।"
সমাজবিজ্ঞানী Frader বলেন, "এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা যার শুরু হয়েছে আদিম সাম্যবাদ থেকে এবং পরিসমাপ্তি ঘটেছে উপনিবেশবাদের মধ্যদিয়ে।"
ড. আবু মাহমুদ তাঁর 'পুঁজিবাদের পুঁজি ও তৃতীয় বিশ্ব' শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, "এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি হলো এমন এক উৎপাদন ব্যবস্থা যাতে রয়েছে বিনিময় ও কৃষির মধ্যে একটি স্বনির্ভর মিল যা উদ্বৃত্ত দ্রব্যকে স্থানান্তরিত হতে দেয় না এবং গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে।"
মার্কস যেসব উৎপাদন ব্যবস্থার (Mode of production) কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলোর মধ্যে Asiatic mode of production অত্যন্ত বিতর্কিত এবং গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি প্রত্যয়টিকে শুধু প্রাচ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে মনে করেননি। অর্থাৎ এটা শুধুমাত্র রাশিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রাচীন মিশর ব্যাবিলন, ইরাক, চীন, ভারতে যেমন এ ধরনের পদ্ধতি পরিলক্ষিত হয়েছিল, তেমনি কলম্বিয়া, পেরু, মেক্সিকো, আজটেক সভ্যতার ক্ষেত্রেও এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তবে মার্কসের মতে, এসব বৈশিষ্ট যেসব সমাজগুলোকে বুঝাতে ব্যবহৃত হলো সেগুলো হলো কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র স্থানীয় সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর সহায়তায় জমির মালিকানা অথবা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং শোষণ করে।
মার্কস তার Capital গ্রন্থে Asian mode of production বা এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, "Those small and extremely ancient Indian communities some of which have continued to this day, are based on possession in common of land, on the blending of agriculture and handicraft and on an unalterable division of labour." অর্থাৎ, ভারতীয় ক্ষুদ্র ও প্রাচীন গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে যার কিছু এখনও বর্তমান রয়েছে, সমষ্টিগত সম্পত্তির মালিকানার উপর প্রতিষ্ঠিত; কৃষি ও কুটিরশিল্পের সংমিশ্রণ এবং অপরিবর্তিত শ্রমবিভাজনের উপর ভিত্তি করে তারা এখনো টিকে আছে।
উইটকোগেল এ ব্যবস্থাকে Oriental Deposition এবং Max Waber এ ব্যবস্থাকে Prebendalization বা Patrimonialism বলে অভিহিত করেছেন।
পরিশেষে বলা যায় যে, এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল প্রাচ্য সমাজের স্থবিরতা ও ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে। এই উৎপাদন পদ্ধতি মূলত এশিয়ার বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে।
এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য। (Characteristics of Asiatic mode of production)
এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
১. ব্যক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতি এবং গোষ্ঠী মালিকানার প্রাধান্য: এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হলো এশীয় সমাজগুলোর ভূমিতে কক্তিগত মালিকানার অনুপস্থিতি। অর্থাৎ তখন সম্পত্তিতে ব্যাক্তিমালিকানা স্বীকৃত ছিল না, রাষ্ট্রীয় মালিকানা ছিল। মার্কসের মতে, এশীয় উৎপাদন পদ্ধতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রাচ্যের সমাজগুলোতে সমগ্র জমির মালিক রাষ্ট্র। রাষ্ট্র কোনো স্থানীয় সম্প্রদায়, গ্রাম বা উপজাতীয় সম্প্রদায়কে হস্তান্তরের অধিকার ব্যতীত শুধুমাত্র ভোগদখলের অধিকার দেয়। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার বলেন, "সমস্ত প্রাচ্য দেশের বৈশিষ্ট্য হলো ভূ-সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অভাব।
২. স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রামীণ সম্প্রদায়: এ হলো এমন এক জীবনধারা। সম্প্রদায় যেখানকার মানুষদের অন্তত তাদের জীবনধারণের মৌলিক উপাদানগুলো মেটাতে বহির্বিশ্বের উপর নির্ভর করতে হয় না। এখানে গ্রাম সম্প্রদায় ছিল শর্তহীন। তবে এই গতিহীনতা ছিল একটি নিয়ামক শর্ত। গ্রাম সম্প্রদায়গুলো ছিল স্পন্দনহীন, অনড়, অল্পে তুষ্টি, চিরাচরিত আদব-কায়দায় অভ্যস্ত জীবনধারা।
৩. শ্রমবিভাজন: এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শ্রমবিভাজন বা Division of labour এ ব্যবস্থায় শ্রমবিভাজন ছিল সহজ সরল। আর এ শ্রমবিভাজন ছিল লিঙ্গভেদে বিভক্ত। মেয়েরা এক ধরনের কাজ করতো এবং পুরুষেরা অন্য ধরনের কাজ করতো, অথবা স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘরে কুটিরশিল্পের কাজ করতো। বস্তুত এ শ্রমবিভাজন ছিল অপরিবর্তনীয়।
৪. বর্ণপ্রথা: বর্ণপ্রথা এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল। ধর্মীয় আবরণে জন্ম নেয়া বর্ণপ্রথার কারণে সমাজ ছিল অনড় এবং অসচল। তাঁতির ছেলে তাঁতি, কামারের ছেলে কামার, সুলতানের ছেলে সুলতান, ব্রাহ্মণের ছেলে ব্রাহ্মণ, নাপিতের ছেলে নাপিত, তাদের নিজ নিজ জাতিবর্ণের পেশায় বংশ পরম্পরায় যুগ যুগ ধরে নিয়োজিত ছিল। এর ফলে এশীয় সমাজ ছিল অপেক্ষাকৃত কম সচল বা স্থিতিশীল।
৫. স্বনির্ভরশীলতা: কৃষি ও কুটিরশিল্পের বিভাজনহীনতা, অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক ও স্বনির্ভরশীলতা ছিল এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ কৃষি ও কুটিরশিল্প ছিল একই অর্থনৈতিক কাঠামোতে বিদ্যমান। এর মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না, বরং একে অপরের উপর নির্ভরশীল ছিল।
৬. স্বৈরতান্ত্রিক শাসন: বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসেচের মাধ্যমে জনসম্পদ ব্যবহারের রীতি গড়ে উঠে। পানিসেচ দেখাশুনার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি বলিষ্ঠ কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র। কারণ কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র ছাড়া এসব ব্যবস্থার সুষ্ঠু সংগঠন ছিল অসম্ভব। যেহেতু প্রাচ্য ছিল কেন্দ্রীভূত এবং এ কারণেই এখানে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের সূত্রপাত ঘটে।
৭. পানি সেচ ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা: পানি সেচ ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল মূলত Asiatic Mode of Production এর অন্যতম বৈশিষ্টা। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের বিশেষত্বের কারণে ভূমিতে কৃত্রিম পানিসেচ ব্যবস্থা করা এককভাবে কোনো ব্যক্তির পক্ষে বা গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কারণে রাষ্ট্রিকে সেচ কর্মের ন্যায় জটিল ও বিরাট কাজটি সম্পাদন করতে হতো। পানিসেচ ছাড়া কৃষি অর্থনীতি সচল রাখা একেবারেই অসম্ভব ছিল।
৮. অপরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থা: মার্কস ও এঙ্গেলস এর মতে, এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম সমাজগুলো ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ, ছোট ছোট রাজ্যের মতো। স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপর গড়ে উঠা গ্রাম সমাজগুলো অপরিবর্তিত থেকে যায়। প্রয়োজনীয় সবকিছুই গ্রামে উৎপন্ন হয় এবং উৎপন্ন প্রব্যের প্রধান অংশ প্রত্যক্ষভাবে গ্রামে ব্যবহার করে এবং তা এখনো পণ্যের রূপ পরিগ্রহ করেনি। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যায়।
৯. উৎপাদিত দ্রব্যের পণ্যের রূপ লাভ না করা: Asiatic Mode of Production বা এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো উৎপাদিত দ্রব্যের পণ্য হিসেবে পরিগণিত না হওয়া। গ্রামীণ সম্প্রদায় উৎপাদিত দ্রব্য নিজেরাই ব্যবহার করতো, উৎপাদিত দ্রব্য অন্য কোথাও বিক্রয় করা হতো না। এব ফলে উৎপাদিত সামগ্রী পণ্যের রূপ লাভ করেনি। গ্রাম সম্প্রদায়ের প্রয়োজনীয় সব প্রব্যসামগ্রী স্থানীয় পরিসরে পাওয়া যেত বলে স্বাভাবিকভাবে কেনা বা বাজারে বিক্রি করার প্রশ্ন আসেনি।
১০. শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অর্থনীতি সমাজ: যেহেতু এশীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতি বিরাজ করতো না, বিনিময় হতো দ্রব্যাদির মাধ্যমে ও গ্রাম ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে শহরের সাথে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। এখানে উৎপাদিত দ্রব্য শুধু নিজের জন্যই প্রস্তুত করতো। উদ্বৃত্ত বলতে কিছু ছিল না। একমাত্র লবণ ও মসলা ছাড়া বাইরে থেকে কোনো কিছু আমদানিও করতো না। মুদ্রা অর্থনীতির অনুপস্থিতি এবং সীমিত মুদ্রা ব্যবস্থার ফলে শহরের সাথে এ সমাজের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে এ সমাজ উন্নয়নের ছোঁয়া বর্জিত সমাজ ছিল।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, উপরে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি বা Asian Mode of Production কে পাশ্চাত্যের উৎপাদন পদ্ধতি থেকে পৃথক করেছিল। এশীয় উৎপাদন পদ্ধতি গড়ে উঠেছিল মূলত প্রাচ্য সমাজের স্থবিরতা ও ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানার অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে।